লাভজনক কবুতর পালন

0
371

পোল্ট্রির মধ্যে কবুতরের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন রকম। কবুতর প্রাচীনকাল থেকে পত্রবাহক ও শখ হিসেবে পালন করলেও এখন বাণিজ্যিকভাবে পালন করা হয়। অন্য পোল্ট্রির চেয়ে কবুতর পালনে পুঁজি কম লাগে, ঝুঁকি কম, পালন সহজ ও লাভ বেশি। পৃথিবীতে ১২০ জাতের কবুতর পাওয়া যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশে ২০ প্রকার রয়েছে।

কবুতর পালনের গুরুত্ব


কবুতর পালনের গুরুত্বঃ
এক জোড়া কবুতর থেকে বছরে ১২ জোড়া বাচ্চা পাওয়া যায়। যার দাম ৩০০০ টাকা। কবুতরের বাচ্চা (২৮-৩০দিন) ও বড় কবুতরের চাহিদা ও দাম বেশি। কবুতর পালনে খরচ কম। বাইরের খাবার বেশি খায়। বাসস্থান খরচ কম। জায়গা কম লাগে। অতিরিক্ত জমি বা জায়গার প্রয়োজন হয় না। বাড়ির আঙিনা, শহরের উঁচু দালানের ছাদে, বারান্দায়, বেলকোনি ও সানশেডে পালন করা যায়। অতিরিক্ত শ্রমিক লাগে না। কাজের অবসরে পালন করা যায়। কবুতর ৪-৫ মাস বয়সে ডিম দেয়া শুরু করে। ১০- ১২ বছর বাঁচে। কবুতরের মাংস সুস্বাদু ও রোগীদের পথ্য। কবুতর পালন সহজ বলে ছাত্রছাত্রী, দুঃস্থ মহিলাসহ সব পেশার মানুষ পালন করতে পারে। কবুতর পালন করে বেকারত্ব দূর, আত্মকর্মসংস্থান বাড়তি আয় ও দারিদ্র্য বিমোচন হয়। কবুতরের বিষ্ঠা জৈবসার হিসেবে জমিতে ব্যবহার করা যায়। পুঁজি কম লাগে, দ্রæত বিনিয়োগ ফেরত পাওয়া যায়। কবুতরের রোগবালাই কম হয়। ১৮ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। কবুতর পালন আনন্দদায়ক। অনেকে শখ করে পালন করে। কবুতরের পালক শিল্প কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। কবুতর উচ্ছিষ্ট খাদ্য ও পোকামাকড় খেয়ে বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে।  এক হিসেবে দেখা গেছে, ৩০ জোড়া উন্নত জাতের কবুতর পালন করে প্রায় এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করে প্রথম বছর প্রায় ৮০ হাজার টাকার বাচ্চা বিক্রি করা যায়। দেশি জাতের ৩০ জোড়া কবুতর পালন করলে ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে প্রথম বছর ৫০ হাজার টাকার বাচ্চা বিক্রি  করা যায়।

পালন পদ্ধতি

পালন পদ্ধতিঃ
কবুতর পালন করা সহজ। ঘর নির্মাণ, খাদ্য ও রোগ ব্যবস্থাপনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কবুতর মুক্ত পদ্ধতি, আবদ্ধ পদ্ধতি ও অর্ধআবদ্ধ পদ্ধতিতে পালন করা যায়।
মুক্ত পদ্ধতিতে পালন : সকালে কবুতর বাসা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সারাদিন এদিক সেদিক উড়ে বেড়ায় এবং খাদ্য খায়। মাঝে মাঝে ঘরে আসে। সন্ধ্যায় ঘরে আসে।
আবদ্ধ পদ্ধতিতে পালন : ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে কবুতর পালন করা হয়। ঘরের ভেতর কবুতরের বাসা বা খোপ তৈরি করে দিতে হয়। বহুতল খাঁচায় পালন করা যায়।
অর্ধআবদ্ধ পদ্ধতিতে পালন : বহুতল ঘর তৈরি করতে হয়। বড় আঙিনায় থাকে। দূরে যেতে পারে না।
আবাসস্থলঃ
কবুতরের ঘর উঁচু স্থানে নির্মাণ করতে হয়। যাতে কুকুর বিড়ালসহ বিভিন্ন প্রাণী আক্রমণ করতে না পারে। ঘরে প্রচুর আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বৃষ্টির পানি, ঝড়ো বাতাস ও শৈত্যপ্রবাহ যাতে না ঢুকে সেদিকে খেয়াল রাখা। হাল্কা কাঠ, পাতলা টিন, বাঁশ বা প্যাকিং বাক্স দিয়ে ও রডের নেট দিয়ে খাঁচা করে ঘর তৈরি করা যায়। প্রতি জোড়া কবুতরের জন্য  ৩০ সেমি. লম্বা, ৩০ সেমি চওড়া এবং ৩০ সেমি উচ্চতা বিশিষ্ট ঘর তৈরি করতে হবে। কবুতরের ঘর পাশাপাশি এবং বহুতল বিশিষ্ট হতে পারে। প্রতি তলার ঘরের সামনে ১২ সেমি. বারান্দা এবং প্রতি ঘরে ১০ সেমি.ঢ১০ সেমি. মাপের একটি দরজা রাখতে হবে। ঘর দক্ষিণমুখী হলে ভালো হয়। ঘরের সামনে খাদ্য ও পানি পাত্র রাখতে হবে। ঘরের সামনে খড়কুটো ও শুকনো ঘাস রাখতে হবে। যাতে কবুতর ডিম পাড়ার স্থান তৈরি করতে পারে।

কবুতরের জাত

কবুতরের জাতঃ
কবুতরের জাত দুই রকম। যথাঃ
ক. স্কোয়াব বা মাংস উৎপাদন জাত : হোয়াইট কিং, টেক্সোনা, সিলভার কিং, হাম কাচ্ছা, কাউরা, ডাউকা, গোলা, হোমার ইত্যাদি।
খ. চিত্তবিনোদন জাত : ময়ূরপঙ্খী, সিরাজি, লাহোরি, ফ্যানটেইল, গিরিবাজ, জালালি, লোটন ইত্যাদি অত্যন্ত জনপ্রিয় জাত। গিরিবাজ কবুতর উড়ন্ত অবস্থায় শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে মানুষের চিত্তাকর্ষণ করে।
কবুতর চেনাঃ    
পুরুষ কবুতর (পায়রা), স্ত্রী কবুতর (পায়রী) ও কবুতরের জাত চেনা প্রয়োজন। একই জাতের একই বয়সের পায়রার চেয়ে পায়রী একটু ছোট। পায়রার মাথায় একটু মুকুট থাকতে পারে। পায়রা ডাকে। পায়রা কে পায়রীর কাছে নিলে পায়রা ঘাড়ের ও দেহের লোম ফোলায়, ডাকে ও পায়রীকে আকৃষ্ট করে। পায়রী সবসময় শান্ত থাকে। পায়রীর পায়ুপথ ডিম¦াকার ও প্রশস্ত থাকে। পায়রা ও পায়রীর পাখার নতুন পালক ঝরে ৮-১০টি নতুন পালক গজালে প্রজনন ও ডিম পাড়ার সময় (বয়স ৪-৫ মাস) হয়। একে রানিং কবুতর বলে। উন্নত জাতের কবুতর আকারে বড় হয়। পায়ে সাধারণত পালক থাকে যা দেখতে সুন্দর।
প্রাপ্তিস্থান ও দামঃ
সরকারি-বেসরকারি খামার, হাট-বাজার ও দোকান থেকে কবুতর  কেনা যায়। সুস্থ, সবল, বয়স (৪-৫ মাস), জাত ও রঙ দেখে কবুতর কেনা উচিত। গ্রামের হাটে দেশি জাতের রানিং কবুতরের জোড়া ৫০০-৬০০ টাকা। উন্নত জাতের জোড়া ৮০০-১৫০০ টাকা। বিদেশি জাতের জোড়া ১৫০০-৩০০০ টাকা। রেসিংসহ বিভিন্ন শখের কবুতরের জোড়া ১৫০০-১ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

কবুতরের খাদ্য

কবুতরের খাদ্যঃ
কবুতর সাধারণত ধান, গম, মটর, খেসারি, ভুট্টা ভাঙা, সরিষা, কলাই, চাল, কাউন, জোয়ার ইত্যাদি খায়। প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক কবুতর দৈনিক গড়ে ৫০ থেকে ৬০ গ্রাম দানাদার খাদ্য খেয়ে থাকে। ছোট কবুতরের জন্য ২০-৩০ গ্রাম ও মাঝারি কবুতরের জন্য ৩০-৩৫ গ্রাম খাদ্য প্রয়োজন। স্বাস্থ্য রক্ষা, দৈহিক বৃদ্ধি ও বংশবৃদ্ধির জন্য খাবারে ১৫% থেকে ১৬% আমিষ থাকা প্রয়োজন। কবুতর বাচ্চার দ্রæত বৃদ্ধি, হাড়শক্ত ও পুষ্টি এবং বয়স্ক কবুতরের সুস্বাস্থ্য এবং ডিমের খোসা শক্ত হওয়ার জন্য ঝিনুকের খোসা চ‚র্ণ, চুনা পাথর, ইটের গুঁড়ো,  হাড়ের গুঁড়ো, লবণ এসব মিশিয়ে গ্রিট মিকচার তৈরি করে খাওয়ানো প্রয়োজন। এ ছাড়াও প্রতিদিন কিছু কাঁচা শাকসবজি কবুতরকে খেতে দেয়া ভালো। প্রতি দুই সপ্তাহে ১ দিন বা ২ দিন যে কোন ধরনের ভিটামিন মিক্সচার খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়ালে কবুতরের রোগবালাই কম হয়। কবুতরকে প্রচুর পানি পান করাতে হবে। কবুতরের ৪ ধরনের সম্পূরক খাদ্য উপাদানের পরিমাণ টেবিল দ্রষ্টব্য।
এ খাদ্য উপাদানগুলো মিশিয়ে নিচের যে কোন এক বা একাধিক খাদ্য মিশ্রণ খাওয়ানো যেতে পারে। প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে খাদ্য দিতে হয়।

বাচ্চা উৎপাদন

বাচ্চা উৎপাদনঃ
পুরুষ ও স্ত্রী কবুতর একসাথে জোড়ায় বসে। প্রাকৃতিকভাবে এদের প্রজনন হয়। খুড়কুটো দিয়ে নিজেরাই বাসা তৈরি করে ডিম পাড়ে। ৪-৫ মাস বয়সে স্ত্রী কবুতর ২৮ দিন পর পর ২ দিন ব্যবধানে ২টি করে ডিম পাড়ে। নতুন জোড়া তৈরি করতে হলে পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ও স্ত্রী কবুতর এক ঘরে খাদ্য পানি দিয়ে ৭-১৪ দিন আবদ্ধ করে রাখতে হয়। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে ১৮ দিন সময় লাগে। স্ত্রী ও পুরুষ কবুতর পালাক্রমে ডিমে ‘তা’ দেয়। বাচ্চার দ্রুত বৃদ্ধির জন্য আলো বাতাসের ব্যবস্থা করতে হয়। কবুতরের ডিম থেকে কৃত্রিমভাবে বাচ্চা ফুটানো যায় না।
বাচ্চার খাদ্যঃ
বাচ্চার বয়স ১০ দিন পর্যন্ত কোনো বাইরের খাদ্য খায় না। এ সময় মা-বাবার খাদ্যথলি থেকে দুধজাতীয় খাদ্য পরস্পরের মুখ লাগিয়ে গ্রহণ করে। বাচ্চার বয়স ২৮ দিন পর্যন্ত ঠোঁট দিয়ে খাদ্য দানা খেতে পারে না। মা-বাবা দানাদার খাদ্য ছোট টুকরা করে বাচ্চার মুখে তুলে খাওয়ে দেয়। ২৮ দিন পর বাচ্চার পাখা গজায়।
রোগ ব্যবস্থাপনাঃ
কবুতরের খাদ্য ও পানির মাধ্যমে জীবাণু দেহের ভেতরে প্রবেশ করে বিভিন্ন রকম রোগ হয়। জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা। যেকোন প্রাণী থেকে কবুতর দূরে রাখা। প্রতিদিন ঘর পরিষ্কার করা। টাটকা সুষম খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি দেয়া। অসুস্থ কবুতর পৃথক রাখা। সুস্থ কবুতরকে টিকা দেয়া। প্রয়োজনে প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে উপযোগী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

রিপ্লাই করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন
দয়া এখানে আপনার নাম লিখুন